‘দেড় মাস গোসল করতে পারিনি। টয়লেটের পানি পর্যন্ত ছিল না। পানি ও খাবারের জন্য আমরা (২৭ জন) সব সময় হাহাকার করেছি। মাঝে মাঝে আফ্রিকান দ্বারা কিছু খাবার পাঠাত। আফ্রিকানরা এসে কুকুরকে খাবার দেওয়ার মতো মেঝেতে ঢেলে দিত। আমরা সেই খাবার কাড়াকাড়ি করে খেতাম।’
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে র্যাব-৫ এর সদর দপ্তরে এভাবেই প্রবাস জীবনের কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন ইয়াকুব আলী (৩৮)। তিনি কুড়িগ্রামের ভোগরা এলাকার ইনজল হোসেনের ছেলে।
র্যাব-৫ জানায়, প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে ভুক্তভোগী ইয়াকুব বাদী হয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানায় মামলা করেন। এই মামলায় মূলহোতা নওগাঁর রানীনগরের সিংগারাপাড়ায় এহরাম সরদারের ছেলে জাহিদ হোসেনকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) রাতে তার নিজ বাড়ি থেকে জাহিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই মামলায় জাহিদের বাবা এহরাম সরদার (৪০), তার ভাই বাবু মোল্লা (৫২), আব্দুল মান্নান (৫০) ছাড়াও ছয়জন আসামি। তাদের মধ্যে শুধু জাহিদ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে।
ইয়াকুব আলী প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে জানান, মুক্তিপণ আদায়কারী জাহিদ হাসান থাকতেন লিবিয়াতে। লিবিয়ার বিভিন্ন আপেল বাগান, অভিজাত অফিসের ভিডিও দেখিয়ে বলতেন ইতালিতে থাকি। সেখানে ভালো বেতনে চাকরি করছি। এমনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালায়। জাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ইয়াকুবের। তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে উন্নত জীবনের আশায় ইতালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় জাহিদের বাবা ইয়াকুবের সঙ্গে মোট ২০ লাখ টাকায় চুক্তি করেন। এর মধ্যে দেশে নেবেন ৫ লাখ। আর ইতালিতে পৌঁছার প্রথম সপ্তাহে বাকি ১৫ লাখ টাকা নেবেন। এভাবে তার সঙ্গে চুক্তি হয়। ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে ২০২৩ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন ইয়াকুবসহ ২৭ জন।
ইয়াকুব আলী বলেন, সেদিন ঢাকা থেকে দুবাইগামী এমিরাত এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে আমরা ২৭ জন দুবাই পৌঁছাই। দুবাই থেকে ফ্লাইটে নাইজার নিয়ে সড়ক পথে পাহাড়, পর্বত, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে আমাদের আলজেরিয়ায় নিয়ে যায়। এই আলজেরিয়ায় আসতে আমাদের তিন দিন তিন রাত লেগে যায়। এ সময় তারা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য খাবার দিয়েছে। এখানে দেড় মাসের মত অমানবিকভাবে একটা আন্ডারগাউন্ড রুমে আমাদের আটকে রাখে।
খাবার ও গোসলের কষ্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেড় মাস আমরা কেউ গোসল করতে পারিনি। টয়লেটের পানি পর্যন্ত ছিল না। পানি ও খাবারের জন্য আমরা সব সময় হাহাকার করেছি। মাঝে মাঝে আফ্রিকান কয়েকজনের দ্বারা কিছু খাবার পাঠাত তারা। তারা কুকুরকে খাবার দেওয়ার মতো মেঝেতে ঢেলে দিয়ে যেত। আমরা সেই খাবার কাড়াকাড়ি করে খেতাম। সেই কষ্টের কথাগুলো মনে হলে চোখ দিয়ে এমনিতেই পানি ঝরে। পরবর্তীতে আলজেরিয়ার বর্ডার ক্রস করে তিউনিসিয়ায় নেওয়ার পরে আমাদের পুলিশ আটক করে। সেখানে জেলে থাকতে হয় ২১ দিন। জেল থেকে বের হওয়ার পরে বুঝলাম- পুলিশের সঙ্গে তাদের সিন্ডিকেট আছে। তারা (জিম্মিকারীরা) আমাদের আবার তাদের কবজায় নিয়ে নেয়। রাতের আঁধারে তিউনিসিয়ায় বর্ডার পাড়ি দিয়ে আমাদের লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে আমাদের নির্যাতনের জন্য আফ্রিকান ও পাকিস্তানি কিছু লোক রেখেছে তারা। সাউন্ড বক্সে গান বাড়িয়ে আমাদের মুখে গামছা পেঁচিয়ে মারধর ও নির্যাতন করে। সেই ছবি ও ভিডিও আবার দেশে পবিরারের কাছে পাঠিয়ে টাকা দাবি করে।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাহিদ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয় ইয়াকুব আলীর। পরিচয় সূত্রে আলাপচারিতায় সে ইয়াকুবকে জানায় যে, সে ইতালি প্রবাসী। ইতালিতে তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক লোক তার মাধ্যমে ইতালিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতালির শ্রম বাজার, উচ্চ বেতন, শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি আকর্ষণীয় বিষয়ে ইয়াকুবকে প্রলোভন দিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রলুব্ধ করে।
২০২৩ সালের ১০ আগস্ট জাহিদ তার বাবা এহরাম সরদার (৪০) ও সম্পর্কে চাচা বাবু মোল্লার (৫২) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন ইয়াকুবকে। এ সময় ভিডিও কলে জাহিদের সঙ্গে কথা বলে ২০ লাখ টাকার প্যাকেজ চূড়ান্ত হয়। এর মধ্যে অগ্রিম ৫ লাখ। আর অবশিষ্ট ১৫ লাখ ইতালি পৌঁছে কাজে যোগদান করার প্রথম সপ্তাহে দিতে হবে। অগ্রিম ৫ লাখ টাকা পরিশোধের ৩ মাসের মধ্যে জাহিদকে ঢাকা হতে দুবাই এবং দুবাই হতে ইতালি নিয়ে যাওয়া হবে। এর মধ্যে জাহিদ ইয়াকুবের ফ্লাইটের দিন, তারিখ ও সময় নিশ্চিত করে আব্দুল মান্নানকে জানায়। জাহিদ এ সময় আব্দুল মান্নানকে জানায়, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে তার আরও ২৬ জন লোক যাবে। তাদেরকে গাইড করে নিয়ে যেতে হবে তাকে।
শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ২০২৩ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর দুবাইগামী এমিরাত এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে ইয়াকুবসহ আরও ২৭ জন ভুক্তভোগী দুবাই পৌঁছায়। দুবাই থেকে ফ্লাইটে নাইজার নিয়ে সড়ক পথে আলজেরিয়া যাওয়ার পর আলজেরিয়া পুলিশ তাদের সকলকেই ধরে নিয়ে গেলে তারা ২১ দিন জেল খাটে। জেল হতে মুক্তি পাওয়ায় পরে আব্দুল মান্নান ও জাহিদ তাদের সকলকেই নিয়ন্ত্রণে নেয়। এরপরে জাহিদ ও আব্দুল মান্নান তাদেরকে আলজেরিয়া থেকে সড়ক পথে তিউনিশিয়া নেয়। তিউনিশিয়া থেকে লিবিয়া নিয়ে তাদের সকলকেই একটি বাড়িতে জিম্মি করে জাহিদের নেতৃত্বে ইয়াকুবসহ অন্যান্য জিম্মিদের অমানুষিকভাবে নির্যাতন করে ও পরনের কাপড় খুলে বিবস্ত্র করে ছবি তুলে এবং ভিডিও ধারণ করে দেশে তাদের পরিবারের সদস্যদের নিকট পাঠায়। এ সময় ইয়াকুবসহ অন্যদের থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। বাদী অন্যান্য ভুক্তভোগীদের নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে মুক্তিপণ দাবি করা নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করেন। এতে লিবিয়ায় অবস্থিত দূতাবাসে কর্মরত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মো. খাইরুল বাশার তাদের উদ্ধার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।
র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ বলেন, চলতি বছরের গত ৯ জানুয়ারি দেশে ফেরত আসেন ইয়াকুব। এরপর ২৫ মার্চ কুড়িগ্রাম সদর থানার মামলা (নং-১৭) করেন। তারই ধারাবিকতায় র্যাব-৫ নওগাঁর রানীনগরে অভিযান চালিয়ে জাহিদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জাহিদ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে কুড়িগ্রাম সদর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ সোহেল মিয়া সরকারি, সম্পাদক : শামীম, বার্তা সম্পাদক : ইসমত প্রধান উপদেষ্টা : মোঃ পিন্টু
ঠিকানা : ২২৪ / ১ ফকিরাপুল, মতিঝিল ঢাকা-১০০০ মোবাইল : ০১৭৬৫৮৯৪১৭১